রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
রবিবার, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
সর্বশেষ
 
 
জগৎ সৃষ্টির যে জটিল সমীকরণ
প্রকাশ: ০৩:৩৭ pm ০৬-০৮-২০২১ হালনাগাদ: ০৩:৩৭ pm ০৬-০৮-২০২১
 
এইবেলা ডেস্ক
 
 
 
 


জেনেভা-সুইজারল্যান্ড। এখানেই অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম পদার্থবিজ্ঞান গবেষণাগার যেখানে ২৫০০ বিজ্ঞানী, কর্মকর্তা ও টেকনিশিয়ান কাজ করে ও সেটা দুর থেকে ব্যবহার করে ১২,০০০ বিজ্ঞানকর্মী।

পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সব যন্ত্রপাতি নিয়ে সেই গবেষণাগারটি এতই বড় যে সুইজারল্যান্ড ফ্রান্স ও স্পেন মিলে এর অবস্থান। এর নাম ইউরোপিয় পারমানবিক গবেষণা কেন্দ্র যাকে সংক্ষেপে বলা হয় সার্ন (CERN)। সার্ন এর মূল গবেষণা হলো পদার্থ তৈরীর সর্বনিম্ন একক মৌলিক কণা (Fundamental particles) নিয়ে।

জেনেভায় সার্নের প্রধান কার্যালয়ের সামনে শোভা পাচ্ছে বিশাল একটি নৃত্যরত শিবের মূর্তি যাকে নটরাজ বলা হয়। পৃথিবীর সর্বাধুনিক একটি গবেষণাগারের মূল দালানের সামনে যেটির মালিক ২৩টি আধুনিক পশ্চিমা দেশ, সেখানে শিবের মূর্তি কেন? মূর্তিটি বসানো হয়েছে খুব বেশিদিন আগেও নয়, এই সেদিন ২০০৪ সালে।

নৃত্যরত শিবের মূর্তি যাকে নটরাজ বলা হয়, শিবের এই মেনিফেস্টেশনে শিবের চারটি হাত। তার একটি হাতে একটি বাদ্যযন্ত্র ডমরু, আর এক হাতে আছে আগুন। শক্তির প্রতীক শিব। ডমরু বাজিয়ে যখন সে নৃত্য করে তখন তার শক্তি থেকে হয় মহাবিশ্বের সৃষ্টি আর অগ্নি হাতে যখন সে নৃত্য করে তখন হয় মহাবিশ্বের ধ্বংশ, সে তখন রুদ্র।

সার্নে ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ লার্জ হেড্রন কোলাইডারের (LHD) মত যে সব দানবীয় পার্টিকেল এক্সিলারেটর আছে সেগুলোর কাজ কিন্তু ক্ষুদ্র স্কেলে নটরাজের মতই। শক্তি ও কণার সৃষ্টি ও ধ্বংশ ঘটিয়ে তাদের রূপান্তরকে বোঝার চেষ্টা করা।

বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী ফ্রিটজফ কাপ্রার একটি বক্তব্য সার্নের নটরাজের বেদীতে লেখা: “শত শত বছর আগে ভারতীয় শিল্পীরা গড়েছিল নৃত্যরত শিবের অনেক রকম ব্রোঞ্জের মূর্তি। আমাদের সময়, পদার্থবিজ্ঞানীরা ব্যবহার করছে সর্বাধুনিক সব প্রযুক্তি মহাজগতের নৃত্যের প্রতিকৃতি তৈরী করার জন্য। মহাজাগতিক নৃত্যের রূপকল্পপটি তাই একীভূত করে প্রাচীন পুরাকাহিনী, ধর্মীয় শিল্পকর্ম ও আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানকে।”

হিন্দু পুরাকাহিনীগুলো যারা রচনা করেছিলেন তারা একটি বিষয়ে সবসময় নিশ্চিত করেছেন যে জগত একটি চক্র। জগতের সব কিছু চক্রের মত ঘুরে ঘুরে আসে। এবং দৃশ্যমান যে বস্তুজগত, সেটা শক্তির চক্রাকার (cyclic) নৃত্যের একটি অস্থায়ী রূপ মাত্র। প্রকৃতির কার্য্যক্রমের এই প্যাটার্নগুলো আদী মুনি ঋষিরা সহজেই ধরে ফেলেছিলেন।

সেই কারণেই কসমোলজি, কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান, মৌলিক কণিকা বিজ্ঞান এগুলোতে যারাই পন্ডিত হয়েছেন, তারা পড়েছেন ভারতীয় মিথ। অনেকে শিখেছেন সংস্কৃত ভাষা। কারন একটাই, সেই প্রাচীন পন্ডিতেরা যদি এতটাই বুঝে থাকেন, নিশ্চই তাদের চিন্তায় আরও কিছু লুক্কায়িত আছে।

পদার্থবিজ্ঞানে মৌলিক কণিকারা যেমন পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক, ভাইরাস তেমন জীবজগতের ক্ষুদ্রতম একক। মৌলিক কণিকারা যেমন শক্তি ও পদার্থের মাঝামাঝি অবস্থিত, ভাইরাসেরাও তেমন জীবজগত ও বস্তুজগতের মাঝামাঝি অবস্থিত। বস্তুজগত যেমন অবিচ্ছিন্ন ও সর্বব্যাপী মৌলিক কণিকার সাগরে নিমজ্জিত, প্রাণীজগতও তেমন অবিচ্ছিন্ন ও সর্বব্যাপী ভাইরাস সাগরে নিমজ্জিত। সেই প্রাচীন পন্ডিতেরা যদি শক্তি পদার্থের নৃত্যটা এতটাই বুঝে থাকেন, জীব ও জড়ের নৃত্যটা সম্পর্কে তারা কি ভেবেছিলেন?

আমরা যারা আধুনিক সময়ে জন্মগ্রহণ করেছি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করেছি তারা যেন নিজেদের গন্ডির বাইরে ভাবতে নারাজ। শক্তি, পদার্থ ও জীবজগত নিয়ে প্রকৃতির কি পরিকল্পনা সেটা নিয়ে আমরা এক বিন্দু চিন্তা করতেও নারাজ। কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রকৃতির কি পরিকল্পনা সেটা নিয়ে কোন কোর্স নেই, সেটা নিয়ে আলোচনা করা হয় না। প্রকৃতি মানে তো ৬৫ ইঞ্চি ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের ডকুমেন্টরিও নয়, ডেভিড অ্যটেনবোরা সেখানে কি লেকচার দিলেন সেটাও নয়। প্রকৃতি মানে জীব ও জড়ের, শক্তি-পদার্থের সেই মিথস্ক্রীয়া – নটরাজের নৃত্য।

আমরা যারা আধুনিক মানুষেরা একটুখানি বিজ্ঞান শিখে, একটু অঙ্ক কষে আর কিছু প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা দেখিয়ে মনে করছি আমরা জ্ঞানের আধার আর আমরা একটা একটি দীর্ঘ, নিঃঝঞ্ঝাট নিরোগ জীবন দাবী করি। মনে করি অহেতুক কিছু রোগ বালাই এসে আমাদের সেই আশায় বাধ সাধছে। অনেকে ভাবে কেউ না কেউ (এখন চীন) এর জন্য দায়ী। আমরা একটি বারের জন্যও কেউ ভাবছি না যে প্রকৃতি কি চায়। আমরা ভাবছি না আমরা কি প্রকৃতির চাওয়ার সাথে, প্রকৃতির কার্য্যক্রমের যে প্যাটার্নগুলো, সেগুলোর সাথে ছন্দ বজায় রেখে চলছি? না কি তাকে অবজ্ঞা করে চলার চেষ্টা করছি?

বর্তমানের বৈজ্ঞানিক ধারনা অনুযায়ী মোটামুটি ১৪ বিলিয়ন বছর আগে এক ‘মহাবিষ্ফোরণের’ মাধ্যমে আমাদের এই বর্তমান মহাবিশ্বের সৃষ্টি। এর প্রথম তিনটি মিনিট কোন নিয়ম কানুনের বালাই ছিল না। যেটাকে পদার্থবিজ্ঞানে ভাষায় বলা হয় সিংগুলারিটি। এর পর পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মকানুনগুলো অর্থাৎ প্রকৃতির আইন কানুনগুলো (physical laws) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে আমাদের বাসস্থান পৃথিবী গ্রহটি তৈরী হয়। এর এক বিলিয়ন বছর পর থেকেই সেখানে প্রাণীজ অস্তিত্বের অবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায়।

প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগে শুরু হয় সালোকসংশ্লেষন প্রক্রিয়া ও এর এক বিলিয়ন বছর পর থেকে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন বৃদ্ধি শুরু হয় যা আগে ছিল না। আড়াই বিলিয়ন বছর আগে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন বর্তমান অনুপাতে আসে। প্রায় এক বিলিয়ন বছর আগে জন্ম নেয় ব্যাকটেরিয়া ও অন্য এককোষী প্রাণী। প্রায় ৭০০ মিলিয়ন বছর আগে জন্ম নেয় বহুকোষী প্রাণী যারা সমুদ্রে বাস করত, তখনই থেকেই শুরু হয় প্রথম যৌন প্রজনন।

প্রায় ৪০০ মিলিয়ন বছর আগে জন্ম নেয় মাছেরা ও প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছর আগে ডায়নোসরেরা। প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর আগে আকাশে ওড়ে পাখি, তার পর পরপরই স্তন্যপায়ীরা জন্ম নেয়। তারও ১০০ মিলিয়ন বছর পরে জন্ম নেয় মৌমাছী এবং তখনই ফোটে প্রথম ফুল। প্রায় ১০ মিলিয়ন বছর আগে এপ প্রজাতীর পূর্বসুরীদের দেখা মেলে।

প্রায় ৪ মিলিয়ন বছর আগে তাদের উত্তরসুরীরাই শুরু করে প্রথম দুই পায়ে বিচরণ। সাড়ে তিন মিলিয়ন বছর আগে পাথরের অস্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু ও দেড় মিলিয়ন বছর আগে শুরু হয় আগুনের ব্যবহার। প্রায় আট লাখ বছর আগে প্রথম রান্না করে খাবার খাওয়া শুরু হয়।

প্রায় তিন লাখ বছর আগে আধুনিক মানুষ বা হোমো স্যাপিয়েনরা আফ্রিকায় বাস শুরু করে ও প্রায় দুই লাখ বছর আগে শরীরের লজ্জাস্থান ঢাকতে বস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। তার পর থেকে শুরু হয় সমাজ ও সংস্কৃতির উদ্ভব। এর পর প্রথা ও ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার আবির্ভাব।

দশ হাজার বছর আগে কৃষি ব্যবস্থার প্রসার ও এর পর চিন্তা, পরিকল্পনা, আদর্শ, নৈতিকতা, রাজনীতি এইসব তথ্য প্রক্রিয়াকরণ নির্ভর তত্বগত মনো-সামাজিক প্রভাবের উদ্ভব। গত দুই হাজার বছরে বিনিময়যোগ্য জ্ঞানের প্রসার ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিগত সমাজের উদ্ভব। গত ৫০ বছর আগে ডিজিটাল প্রসেসিং এর উদ্ভব যার ফলে যন্ত্রের মধ্যে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ শুরু।

সৃষ্টির শুরু থেকে ডিজিটাল যুগ পর্যন্ত এই পুরো বিবর্তন প্রক্রিয়াটাকে যদি আমরা প্রকৃতির ট্রেন্ড হিসাবে দেখি তবে আমরা দেখতে পাই শক্তি থেকে পদার্থের উদ্ভব ১৪ বিলিয়ন বছর আগে, ৪ বিলিয়ন বছর আগে মাটি, ৭০০ মিলিয়ন বছর আগে প্রাণ, ৬ মিলিয়ন বছর আগে পরিকল্পনা করতে পারে এমন মন, এক লাখ বছর আগে থেকে আধ্যাত্মিকতা-সংস্কৃতি যা বর্তমানে ডিজিটাল প্রসেসিং পর্যন্ত বিস্তৃত।

তার মানে শক্তি থেকে পদার্থ হয়ে ভার্চুয়াল তথ্য প্রক্রিয়াকরণের দিকে প্রাণি-প্রকৃতি-জগত চলছে। সেই ভার্চুয়াল তথ্য প্রক্রিয়াকরণ প্রাণিদের মগজেই হোক বা ডিজিটাল প্রসেসরে। অর্থাৎ বস্তুজগতের ক্রিয়াকলাপকে তথ্যে রুপান্তর করে চিন্তায় সেগুলোকে প্রসেস করার (হোক মস্তিস্কে অথবা ডিজিটাল প্রসেসরে) পথেই যেন প্রকৃতি অগ্রসরমান। লক্ষ্যটা যেন বস্তুগুত ঘটনা থেকে চিন্তাগত সিমুলেশনের দিকে ধাবমান।

আমরা যদি একটু ভিন্ন দিক থেকে বিষয়টা দেখি। যে কোন ডিজিটাল প্রসেসরকে যদি অতি শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপের নিচে রাখা হয় তাহলে দেখা যাবে সেটা কিছু মৌলিক কণিকার সন্নিবেশ মাত্র তবে তাদের সজ্জাটা অতি জটিল একটা শক্তি-কণিকা মেট্রিক্স। তেমনভাবে মানুষের মগজ বা যে কোন বায়োলজিক্যাল প্রসেস মাইক্রো স্কেলে কোষের তড়িৎ-রাসায়নিক ক্রিয়া মাত্র। যে কোন রাসায়নিক ক্রিয়াকে মাইক্রো স্কেলে দেখলে দেখা যাবে সেগুলো অণু পরমাণুর বাইরের কক্ষের ইলেকট্রনগুলোর শক্তির খেলা মাত্র।

সেটাকে আবার আরও ক্ষুদ্র স্কেলে দেখলে সেগুলো মৌলিক কণিকাগুলোর সাথে শক্তি ক্ষেত্রগুলোর প্রতিক্রিয়া মাত্র। তার মানে মাইক্রো স্কেলে জীববিজ্ঞান আসলে রসায়ন বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান আসলে পদার্থবিদ্যা আর পদার্থ বিদ্যা আসলে মৌলিক কণিকা আর শক্তিক্ষেত্রের মিথস্ক্রীয়।

তাহলে যে কম্পিউটরের সামনে বসে আমি লিখছি বা যে মাথার মগজ থেকে লেখাগুলো বেরোচ্ছে সেগুলো কি? সেগুলো ওই মৌলিক কণিকা আর শক্তিক্ষেত্রের মিথস্ক্রীয়া মাত্র তবে একটি নির্দিষ্ট মেট্রিক্সে সাজানো। যেখানে মুল বিষয়টি হল সেই মেট্রিক্সটি কিভাবে সাজানো থাকবে সেই তথ্য এবং সে বিষয়টি নিয়ে সেই মেট্রিক্স কাজ করছে (আমার এই লেখার বিষয়) সেগুলোও তথ্য।

প্রাচীন পন্ডিতেরা যেমন নৃত্যরত শিবের মূর্তি বা নটরাজের কল্পনা করেছিলেন ডমরু বাজিয়ে মহাবিশ্ব সৃষ্টির বা আগুন দিয়ে সেটি ধ্বংশের, তারা জীব ও জড়ের নৃত্য সম্পর্কে বলেছিলেন জীবরে স্বপ্নটা আসল, তার দেহ, তার চারপাশের বস্তু ও বাস্তবতা মিথ্যা, মায়া। চেতনায় যা ঘটে, সেটা রয়ে যায়, সেটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়াই জীবের কাজ। দেহ-বস্তু ত্যজ্য।

ব্রহ্মান্ড পুরাণে আছে “অনন্ত শূন্যতায় শান্ত বিশাল কৃষ্ণ মহাসাগরে ভাসমান এক বিশাল নাগরাজ যার নাম অনন্ত শেষ। তার দেহের উপরে শয়নে ভগবান বিষ্ণু বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর নাভি থেকে একটি পদ্মফুল গজিয়ে উঠেছে ও ভগবান ব্রহ্মা সেই পদ্মের একটি পাপড়ির উপরে বসে।

যিনি ঐশ্বরিক শক্তি এবং ঐশ্বরিক অনুগ্রহের প্রতীক, যিনি স্রষ্টা। ব্রহ্মার স্ত্রী হলেন দেবী সরস্বতী। সরস্বতী তাঁকে সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় সহায়তা করার জন্য মাতৃদেবী রূপে আবির্ভূতা। প্রতিবার ঘুমন্ত ভগবান বিষ্ণু যখন চোখ খুলেন মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়, আবার তিনি যখন ঘুমিয়ে যান, স্বপ্ন দেখেন, সব সৃষ্টি হয়।”

বিষ্ণু সেই ঘুমন্ত দেবতা, যার স্বপ্নই বিশ্বজগৎ, তাই সেটা মায়া। আসল হল চেতনা। যেটাই লক্ষ্য।

হিন্দু বেদ, পুরাণ অথবা আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞান দুটোই একই কথা বলে সেটা হল পদার্থ বা বস্তুজগত আসলে বিভ্রম। পদার্থ দ্বারা তৈরী সব কিছুই বিভ্রম, মায়া। এই যে আমাদের শরীর, সেটাও প্রকৃতির লক্ষ্য নয়, এর মাধ্যমে জটিলতর তথ্য মেট্রিক্স তৈরী করা প্রকৃতির লক্ষ্য।

একটি ইলেকট্রনের সরলতা থেকে একটি ২৮ কোর জিয়ন ডব্লিউ প্রসেসর বা একটি এককোষী প্রাণীর সরলতা থেকে মানব মস্তিষ্কের মত জটিল ও জটিলতর বিন্যাসের খেলায় যে আরও সামনে যেতে চায়। এবং সেটা করতে গেলে সে চায় পরিবর্তন, রূপান্তর, মিউটেশন। ভাইরাস, ক্যান্সার, ধ্বংশ বিপর্যয় তার পরিবর্তনের অস্ত্র।

এই যাত্রায় মানুষ যদি প্রকৃতির সাথে সমঝোতা করে না এগিয়ে নিজের আরাম আয়েশের জন্য সৃষ্ট বস্তুজগতের উন্নয়ন আর শারীরকে একই আদর্শে স্থিত রেখে এগিয়ে যেতে চায় সেটা হবে প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক। এবং এই সংঘর্ষে কে জিতবে তা আমাদের সকলেরই জানা।

যুগে যুগে প্রায় সকল ধর্মের চিন্তক বা ভারতীয় মুনি ঋষিরা তাই বলেছেন বস্তু মায়া, দেহ মায়া ত্যাগ কর, চিন্তার জগতে এস। দার্শনিকেরা বলেছেন প্লেন লিভিং হাই থিংকিং এর কথা।

বলেছেন পরিণত মানুষ হওয়া মানে ক্রমেই ইন্দ্রিয়কে অবজ্ঞা করা চিন্তার জগতে আসা কারণ দেহের মৃত্যু হয় চিন্তার নয়। চিন্তাকে পরের প্রজন্মের হাতে সমর্পন করাই আমাদের লক্ষ্য যাতে পরের প্রজন্ম প্রকৃতির গতি প্রকৃতি বুঝতে পারে ও সে নিজেকে সেই পথের জন্য প্রস্তুত করতে পারে।

ঋগ্বেদে ৩৫০০ বছর আগে লিখা হয়েছিল “কে ই বা জানে নিশ্চিতভাবে? কে ই বা ঘোষণা করবে এখানে? কখন সবকিছুর জন্ম হয়েছিল? সৃষ্টি কখন শুরু হয়েছিল? দেবতারা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির পরে সৃষ্ট, তাহলে মহাবিশ্বের শুরুটা কে জানে? কেউ জানে না কখন সৃষ্টির শুরু হয়েছিল, অথবা কেউ এটা তৈরী করেছে বা করেনি – যিনি এটাকে নিরীক্ষণ করছেন উর্দ্ধ আকাশ থেকে। শুধু তিনিই জানেন, অথবা সম্ভবতঃ তিনিও জানেন না।”

এই জানার চেষ্টাই তারা করেছিল। এতে তারা এতটাই সফল ছিল যে তারা আবিষ্কার করেছিল প্রকৃতির অনেক নিয়ম যাতে আধুনিক বিজ্ঞানীরা এতটাই বিস্মিত যে তারা বার বার ছুটে এসেছেন এই আমাদেরই দেশে, এই মাটিতে, অনেকে শিখেছেন আমাদেরই মাতৃভাষার পূর্বসূরি সংস্কৃত ভাষা। শ্রোয়েডিংঞ্জার থেকে নিলস বোর, হাইজেনবার্গ, ওপেনহাইমার, টেসলা – এমন নাম অনেক যারা সেটা খোলাখুলি বলেই গেছেন।

এর পর ৩৫০০ বছর আমরা বেদ উপনিষদের সেই সাহসী শিক্ষাটায় আর এগোইনি তেমন। ধর্ম মানে আমরা ইগো, দলাদলি আর অন্ধ বিশ্বাসের প্রচার প্রসার বুঝেছি। দর্শনকে অবলিলায় হত্যা করেছি।

বিজ্ঞানও পরিণত হয়েছে জীবনকে আরাম আয়েশী করার পণ্য বিক্রির দাসে। যা আসলে বস্তুজগতের সমৃদ্ধি আর শরীর কেন্দ্রীয় জ্ঞানে সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ ঠিক বেদ উপনিষদে যে পথ পরিহার করতে বলা হয়েছে, সেটার সেবায় এখন নিয়োজিত।

গত ২০ বছরেই তিনটি মারাত্মক করোনাভাইরাস বাদুড় থেকে মানুষে স্পিলওভার হয়ে জুনটিক ট্রান্সফার ঘটেছে। প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে মানুষের বস্তুগত ভোগ ও শারীরিক নিরাপত্তার জন্য আমরা মানুষের বসবাস এমনকি কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ও পশুপালনকেও প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন করে যেন মানুষের জন্য একটা বিকল্প নকল প্রকৃতি তৈরীর চেষ্টা করে চলেছি। মহা জটিল আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন করে ল্যাবরেটরিতে তৈরী ওষধ ভ্যকসিন নির্ভর করে ফেলছি। প্রকৃতি কি এই ধৃষ্টতা মেনে নেবে? কখনই না।

নি এম/সিরাজুল হোসেন

 
 
 
   
  Print  
 
 
 
 
 
 
 
 
আরও খবর

 
 
 

 

Editor & Publisher : Sukriti Mondal.

E-mail: eibelanews2022@gmail.com

a concern of Eibela Ltd.

Request Mobile Site

Copyright © 2024 Eibela.Com
Developed by: coder71