অনিকেত মহাপাত্র
চীন, ডোকালাম বিতর্কের সময় টের পেয়ে গেছিল যে কী হতে চলেছে । তবু ড্রাগনকে নিজের নড়াচড়া সারতে হবে বিভিন্ন সময়। এই পরিস্থিতি এখন বারে বারে আসবে। কারণ ভারতের যেকোনো রকম সক্রিয়তা সবসময় চীনের পক্ষে অস্বস্তির। দূর্বল প্রতিবেশী প্রত্যেকের পক্ষে কাঙ্খিত। চলছিলও ঠিকঠাক যা ক্রমশ আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। কিন্তু ভারতেরও যে রূপান্তর ঘটছে সেটি চীনের নজরে থাকলেও তার আত্মবিশ্বাসের চাদরকে ভেদ করতে পারেনি। চীন হঠকারিতাই করেছে। চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর বা সিপিইসি আসলে ড্রাগনের খাদে পড়া। যার থেকে চীন এখন না পারবে বেরোতে না পারবে তাকে পূর্ণ করতে। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময়ের শীতলতা বলুন বা স্থিতাবস্থা, ভারত এইভাবে ভেঙে ফেলবে, তা চীন আশা করেনি। বরং ভারতের ভৌগোলিক পরিধির আরও সংকোচন আশা করেছিল। ছেচল্লিশ বিলিয়ন ডলারের এই সিপিইসি পরিকল্পনা ছিল দুটি স্বপ্নের ফসল। পশ্চিম চীনের সঙ্গে এই এক্সপ্রেস লিংক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে আফ্রিকাকে জুড়ে দেবে, যে আফ্রিকা এখন হতে চলেছে ড্রাগনের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য। চীনের এই সুদূরপ্রসারী স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পাকিস্তানের বাস্তববুদ্ধি। মুখেই যত হম্বিতম্বি করুক পাকিস্তান, সে জানে তার কী অবস্থা। সেই সঙ্গে ভারতকে তার মতো এতো ভালো আর কেউ চেনেনা।
ভারতের বিদেশনীতির জড়ত্ব যে কোনো সময় কাটতে পারে কিংবা কাটতে চলেছে তা ধারণায় ছিল তাদের। আর এই মুহূর্তে পাকিস্তানের নতুন করে কিছু পাবার নেই। বরং ধরে রাখতে পারবে কিনা সেই ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। বালোচিস্তান নিয়ে তাদের মধ্যে ট্রমা তৈরি হয়েছে, একাত্তরের দুঃস্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তাদের ধারণায় রয়েছে ভারত সবচেয়ে বেশি হলে এগোবে পাক অধিকৃত কাশ্মীর অবধি, তার বেশি নয়। এর বেশি করার হলে অনেক আগেই করে ফেলতো তাই তারা চেয়েছিলো এমন এক শক্তির উপস্থিতি ওই অধিকৃত কাশ্মীরে যাদের কারণে ভারত এগোনোর কথা ভাববে না। পাকিস্তানের উর্বর বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। যাদের পররাষ্ট্রনীতি স্থির হয় ভারতকে লক্ষ্য রেখে, বিদেশ দপ্তরের মোট বিবৃতির সংখ্যা ও তার মধ্যে ভারত কেন্দ্রিক বিবৃতির সংখ্যার তুলনা করলে কিংবা পাকিস্তানের থিঙ্ক ট্যাংকগুলির প্রতিবেদন বা পাকিস্তানের বিখ্যাত সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় এবং উত্তর সম্পাদকীয় লেখাগুলিতে ভারত কেন্দ্রিকতার জোয়ার দেখলে বিষয়টি বোধগম্য হয়। যে কারণে মাঝে মাঝে মনে হয় এতই যখন অনুরাগ কী দরকার ছিল আলাদা হবার! সে যাই হোক, মরীয়া পাকিস্তান যাদের হারাবার মতো কিছু নেই, তারা চীনের দেওয়া সিপিইসি-র প্রস্তাব লুফে নেয়, এতে ভারতকে আটকানো যাবে আবার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও লাভজনক হবে বিষয়টি। সবই পরিকল্পনা মতো চলছিল কিন্তু ভারতের আর্টিকেল ৩৭০ তুলে দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ এর পাক অধিকৃত কাশ্মীর ও আকসাই চীন নিয়ে বিবৃতি ড্রাগনের টনক নড়িয়েছে। এর মধ্যে অনেক অর্থ বিনিয়োগ করা হয়ে গেছে। চীন তার পুরো শক্তিতে পরিকাঠামো নির্মাণের কাজ করে গেছে। আর ফিরে আসার পথ গ্রহণ করাটা তার পক্ষে অসম্মানজনক শুধু নয় প্রভূত আর্থিক ক্ষতির কারণ। ফলে চীনের ছায়া যুদ্ধের দিন শেষ, পাকিস্তানকে ঠেলে আর কাজ হচ্ছে না নিজেকে সামনে আসতে হচ্ছে নিজের সম্ভাব্য ক্ষতি আটকাতে। যে কারণে লাদাখের মতো জায়গায়ও অতি সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে তাদের। চীন, ভারতের এফডিআই নীতির পরিবর্তন বা ভারত নির্মাণ অভিযানের ফলে সম্ভাব্য আর্থিক ক্ষতি নিয়ে ভাবিত নয়। কারণ সস্তা পণ্যের যে স্বাদ সে দিয়েছে তার ঘেরাটোপ থেকে বেরোনো খুব সোজা নয় কিংবা তাদের দেশের পরিকাঠামোতে যত সহজে ও কম অর্থ বিনিয়োগে উৎপাদন করা যায় তার সুযোগ মুনাফাখোররা এত তাড়াতাড়ি ছাড়বে না। চীন সেটা খুব ভালো করে জানে। সে ভাবিত আফ্রিকায় তার ভবিষৎ নিয়ে। যার লাইফ লাইন এই সিপিইসি। আমেরিকা চীনের এই দুর্বলতা বোঝে তাই সেও এই খেলাটা উপভোগ করছে। তাই মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। ভারতের ক্ষেত্রে POK এবং আকসাই চীন সম্মানের প্রশ্ন।
ভারতের নতুন ধারার বিদেশ নীতির সাফল্য এখানেই যে, আকসাই চীনের ব্যাপারটা প্রায় লোকে ভুলতে বসেছিল। চীন ভারতের ওপর চাপ তৈরি করতে অরুণাচল নিয়ে ঘাঁটাতো। কিন্তু এবার পাল্টা চাপে থাকবে ড্রাগন। কারণ সে এক গভীর গর্তে পড়ে গেছে। তার ঔদ্ধত্য ও সীমাহীন আত্মবিশ্বাস পাকিস্তানের তৈরি গর্তে তাকে ফেলে দিয়েছে। তার গতি তাকে এইদিকেই টেনে নিয়ে যেত। কারণ আফ্রিকার মরীচিকা ছিল তার সামনে। এই মুহূর্তে কোভিড নিয়ে যে পরিস্থিতি ও চীনের কোনঠাসা অবস্থা তাতে চীনের বাড়াবাড়ি করার ক্ষমতা কমেছে। যতই তাদের সেনাকে প্রস্তুত থাকতে বলা হোক, আর যুদ্ধ করে অর্থ খরচ করার মতো মানসিকতা চীনের এই মুহূর্তে নেই। কিছু চীনা বাঁদরামি দেখা যাবে এর বেশি কিছু নয়। তবে ভারতের সামনে এই মুহূর্তে সুযোগ ছিল চীনকে আর একটু বেশি কোনঠাসা করার। ড্রাগনকে এই রকম চাপের মধ্যে সবসময় পাওয়া যাবে না। তবে ভারতের পক্ষে কোভিডের কারণে আর্থিক ক্ষতির চাপ কাটিয়ে বাড়তি চাপে রাখার কৌশলকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব সেটাও অভিনিবেশ দাবি করে। তবে সুযোগ ছিল চীন যেমন আক্রমণ ও অতিসক্রিয়তাকে নিজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে চালাতে চেষ্টা করে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারই অস্ত্রে তাকে ঘায়েল করাই বিধেয়। সেই সঙ্গে আমেরিকার ছায়া এই ক্ষেত্রে না গভীর হয়ে পড়ে সেটা দেখা দরকার। তবে ভারত কোভিড পরবর্তী সময়ে POK, আকসাই চীন এবং সিপিইসি নিয়ে শুধু সরব হওয়া নয় কার্যকরী কিছু ব্যবস্থা নেবে, এটা নিশ্চিত। আর ভারত-পাক রুটিন মাফিক গুলি বিনিময়ের সময় দু-চারটে মর্টার চীনের স্বপ্নের সিপিইসি-র এক্সপ্রেস লিংকের ওপরও পড়তে পারে। তখন চীন কীভাবে সামলায় সেটাও দেখার বিষয়। ড্রাগন যেভাবে সিপিইসি-র গর্তে পড়েছে তাতে মনে হয় অনেকটা বেশি খেসারত দিতে হবে তাকে।
নি এম/
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com