বিজ্ঞানের নিত্য-নূতন আবিষ্কারের সাথে পাল্লা দিয়ে জীবনের নানা ক্ষেত্রে এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।যাতায়াত ব্যবস্থা, যোগাযোগ মাধ্যম, আমোদ-প্রমোদ, খেলাধূলা,খাদ্যাভাস, পোষাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি সর্বত্রই লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া।নতূনদের স্বাগত জানাতে গিয়ে পুরানোদের আমরা পাঠিয়ে দিয়েছি ইতিহাসের পাতায়। তাদের অপরাধ তারা যুগোপযোগী,কেমন যেন সেকেলে। চারদিকে এত পরিবর্তনের মাঝেও যোগ কিন্তু দিব্যি রয়েছে একই রকম ভাবে। শরীরচর্চ্চার এত আধুনিক যন্ত্রপাতি, জিম,মাল্টিজিম, অ্যারবিক্স ও অন্যান্য নানা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পাশাপাশি হাজার হাজার বছরের প্রাচীন পদ্ধতি যোগ এখনো সমাদৃত হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে। মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে যোগের অন্তর্গত আসন, ধৌতি, প্রাণায়াম, ধ্যান প্রভৃতি এত পুরানো তবুও বাতিল হলো না কেন? বাতিল হবে কি করে? মানুষের শরীর ও মনের সর্বাঙ্গিন যত্ন যোগ যেভাবে নেয় অন্যকিছু তা পারে না। তা সত্ত্বেও মানুষ যোগের ধারে কাছেও আসে না। ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন বদলে যাবে আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, থাকবেনা বর্তমানের অনেক খেলাধুলা ও শরীরচর্চ্চা পদ্ধতি। অতীতের অনেক জনপ্রিয় খেলার মত এগুলোও চলে যাবে স্মৃতির অন্তরালে। সেদিনও দেখাযাবে যোগ রয়েছে স্বমহিমায় আমাদের জীবনের মাঝে একই রকম ভাবে। কারন যোগ সবসময় যুগোপযোগী। যোগকে কখনো পুরানো বা বাতিল যোগ্য মনে হবে না। ধনী-দরীদ্র,শিক্ষিত-অশিক্ষিত,ছোট-বড় সকলের জন্য যোগ উপযোগী। যোগাভ্যাস এনে দিতে পারে দৈহিক ও মানসিক সুস্থতা। জীবন হয়ে উঠে প্রনবন্ত যা আমাদের সকলের কাম্য। তাই দৃঢ়ভাবে বলা যায় সার্বিক সুস্থতায় যোগের কোন বিকল্প নেই।যোগ অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে ও ভবিষ্যতেও থাকবে।
পৃথিবীর সর্ব প্রাচীন আমাদের এই বৈদিক/ সনাতন ধর্ম, একাধারে জ্ঞান ধর্ম ও ভক্তি ধর্ম যোগও এই জ্ঞান ধর্মের অন্তর্গত। বৌদ্ধধর্ম,খৃষ্টধর্ম ও ইসলামধর্ম মুলতঃ ভক্তিধর্ম।সনাতন ধর্মে ভক্তি ধর্মের যে দার্শনিকতা আছে, যে রস মাধুর্যতা আছে উহার স্বাদ যখন অন্যান্য ধর্মাবলম্বিরা পাইবেন তখন তাঁদের ভক্তি ধর্মও পূর্ণতা লাভ করিবে। সনাতন ধর্ম অন্য কোন ধর্মকে লুপ্ত করে না, গ্রাসও করে না,উহাকে পূর্ণতা প্রদান করে।সনাতন ধর্ম যেন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, অন্য ধর্ম হলো কনিষ্ঠ ভ্রাতা।কনিষ্ঠ ভ্রাতারা যখন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মত অধ্যাত্মভাবে ভাবিত হবে, অধ্যাত্মজ্ঞানে সমকক্ষ হয়ে উঠবে তখন প্রতিবী হতে ধর্মের বাড়াবাড়ি,গোড়াঁমি ও সাম্প্রদায়িকতার বীষ বাস্প পৃথিবী হইতে বিদুরিত হবে। সবার উপরে মানুষ সত্য,সবার উপরে মানুষের অন্তর্নিহিত অদ্বয় অখন্ড সর্বব্যাপী পরমাত্মা চেতনাই সত্য, এই মহাসত্য লাভ করাই মানুষের কাম্য।মানুষে মানুষে কোন ভেদ নেই,এক সত্য, এক ভগবান।খন্ডের মাঝে আছেন তিনি অখন্ডরূপে,দ্বৈতের মাঝে আছেন তিনি অদ্বৈতরূপে,সর্ব জীবের মাঝে আছেন তিনি পরমাত্মারূপে এই বৈদিক জ্ঞানের প্রভায় সমগ্র মানব জাতি প্রভাস্বর হয়ে উঠুক।সময় সময় আমাদের দৃষ্টির সম্মুখ হতে বর্তমান যুগের যবনিকা সরে যায় আর ফুটে ওঠে ভাবীকালের অপরূপ দৃশ্য- এই মৃন্ময়ী পৃথিবীর চিন্ময়ীরূপ,প্রকৃতি মাতার চিন্ময়ীরূপ। দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাই যোগ বিদ্যার বিজয়।আর এই যোগ বিদ্যা আয়ত্ব করে এই পশু মানবের লীলাভূমি জগৎ দেবমানবের লীলাভূমিতে রূপায়িত হয়ে উঠেছে। এই দেবভূমিতে জরা নেই,ব্যাধি নেই, অকাল মৃত্যূ নেই,দারিদ্র নেই,দূঃখ নেই,হিংসা-দ্বেষ-স্বার্থপরতা নেই,কাম-ক্রোধাদি রিপুর প্রধান্য নেই।এই জগতের মানুষ যেন জ্ঞান, প্রেম ও অহিংসার জীবন্ত প্রতীক। দেব ভাব ও ভগবত ভাবের জীবন্ত বিগ্রহ। এ যেন কোটি কোটি বুদ্ধ, খৃষ্ট, শঙ্কর,গৌরাঙ্গ,রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের একত্র সমাবেশ।
৷ সর্বান্তকরণে অনুভব করি এই দেব সৃষ্টি রূপায়নই প্রকৃতির লক্ষ্য। প্রকৃতির এ দেব সৃষ্টি রূপায়নে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তার জন্যই পৃথিবীর বুকে আমাদের জন্ম।আমাদের জী বন যজ্ঞের সমূদয় আহুতি সার্থক হবে যদি আমরা আমাদের এই উদ্দেশ্যকে, লক্ষ্যকে রূপায়িত করতে পারি। আর এর জন্য দরকার নীরোগদেহ, শুদ্ধদেহ ও বিশুদ্ধ জ্ঞানোজ্বল মন যা মনোরাজ্য অতিক্রম করে লাভ করতে হবে আত্মস্বরূপের অমৃত ধারা।এই অমৃতস্পর্শে মানুষ হয় দিব্য জ্ঞানের, দিব্য প্রেমের জীবন্ত বিগ্রহ।
এই আত্মোন্নতি ও আত্মানুভবের যতরকম পথ আছে যোগ তার মাঝে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।যোগের আসন -মুদ্রাদি শরীরকে নীরোগ করে,মনকে শান্ত, সবল ও নির্মল করে। প্রানায়ামের সাহায্যে আমরা অতীন্দ্রিয় রাজ্যে গমন করে আত্মাকে পরমাত্মার সাথে যুক্ত করে মোক্ষ লাভ করতে পারি। এইভাবে একসঙ্গে দৈহিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক এই ত্রিবিধ উন্নতির ব্যবস্থা ভক্তিপথে নেই, জ্ঞানপথে ও নেই আছে শুধু যোগপথে।
আমাদের প্রাচীন যোগশাস্ত্রও আছে কিন্তু যোগের বাস্তব প্রয়োগ প্রনালী বহুলাংশে লুপ্ত হয়েছে।আমরা দেখেছি বর্তমান যোগাচার্যগন এই লুপ্ত যোগবিদ্যার কিছু কিছু উদ্ধার করে কিছু কিছু নতুন যোগক্রিয়া উদ্ভাবন করেছেন। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে ঘোষনা করতে পারি সাধরন মানুষ জরা-ব্যাধি-অকালমৃত্যূ জয় করে শতায়ূ লাভ করতে সক্ষম হবে। এই যোগবিদ্যা দ্বারা পৃথিবীর সমুদয় মানুষ যোগযুক্ত হয়ে উপকৃত হউক ইহাই যোগাচার্য্যগনের কাম্য।
পৃথিবীতে চিরশান্তি অব্যাহত রখার জন্য মানব সভ্যতার বাধাহীন অগ্রগতির জন্য এই যুগেই আমাদের মাঝে বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্টার কামনা জাগরিত করতে হবে। বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সার্বজনীন ধর্মেরও প্রয়োজন হবে। বাইবেল,ত্রিপিটক,কোরান ইত্যাদি সর্বশ্রনীর মানুষের অধ্যাত্ম ক্ষুধা মেটাতে পারবেনা সেই ক্ষুধা মিটিয়ে শান্তি প্রদানের ক্ষমতা একমাত্র আছে বেদোক্ত জ্ঞান-যোগ-ভক্তি,তথা সনাতন ধর্মের। যোগবিদ্যা আজ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন ঘটিয়ে চলছে।পাশ্চাত্যবাসীর যোগশিক্ষার আগ্রহ দেখে আমরা আজ মুগ্ধ।
বেদের ঋষিগন নিজেদের ধর্মকে বলেন সনাতন ধর্ম,শাশ্বত ধর্ম। এই ধর্ম কোন মতবাদ নয়।ইহা সত্যানুভুতির উপর প্রতিষ্ঠিত।এই ধর্ম কোন সম্প্রদায় বাকোন নির্দিষ্ট জাতির ধর্ম নয়।ইহা সার্বভৌম ধর্ম,সমগ্র মানব জাতির ধর্ম। এ ধর্মের সত্যানুভুতিরূপ অমৃতকে নিজে আস্বাদন করে বিশ্ববাসী সকলে যাতে এই অমৃত আস্বাদনের অধিকারী হয় - সাধ্যমত তার চেষ্টা করাই হোক আমাদের ব্রত। মানুষ দেবত্ব লাভের প্রয়াসী। স্বীয় অন্তরের দেবতার স্পর্শে মানুষও দেবতা হয়ে উঠবে আর এই দেবত্ব লাভের পথ সুগম করার দায়ভার আমাদের সকলের।পরমাত্মার কৃপায় এই প্রচেষ্টা সার্থক হউক।
খাদ্যই জীবনী শক্তি,খাদ্যই প্রাণশক্তি।মানুষ সুখাদ্য গ্রগন করে যাতে দেব মনের অধিকারী হতে পারে তার জন্য প্রকৃতি উদ্ভিদ জগৎ সৃষ্টি।করেছেন।এসকল উদ্ভিজ খাদ্যকে বলা হয় সুখাদ্য বা সাত্ত্বিক খাদ্য। অপরপক্ষে অসাত্ত্বিক খাদ্যই শারীরিক ও মানসিক অবনতির মূল কারন। সর্বোপরি গীতার ৩য় অধ্যায় কর্মযোগের মাধ্যমে জল, মাটি ও বায়ু তথা পরিবেশ দূষন রোধকরে যোগযুক্ত হয়ে শারীরিক,মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়ন নিশ্চিত করি।
৷ ওঁ সর্ব্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্ব্বে সন্তু নিরাময়াঃ।
সর্ব্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু মা কশ্চিৎ দূঃখ ভাগ্ ভবেৎ।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।
সবাই সুখি হোক, সকলেই সুস্থ থাকুক,সকলের দৃষ্টি যেন শুভ হয়,কেউ যেন কখনো দুঃখ ভোগ না করেন।
এই হলো বিশ্বজনীন প্রার্থনা।
নি এম/ তারাপদ শিকদার
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com