শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮) উনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম একজন শিক্ষা সংস্কারক, লোক শিক্ষক এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। প্রাচীন ভারতের সনাতন ধর্ম কে ক্ষয়িষ্ণু করেছিল পুরোহিত সম্প্রদায়ের অতি বাড়াবাড়ি নিয়ম নীতি, সৃষ্টি হয় জাতপাত। তাঁরা মানব জীবনে চাপিয়ে দেয় দেশাচার, লোকাচার, বিভিন্ন ধর্মীয় কুসংস্কার ও বিধি নিষেধের বেড়াজাল। সনাতন ধর্মের ভেদাভেদ প্রবল আকার নেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভাব ঘটে শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের। তিনি সহজ,সরল ভাবে সংসারী দের জন্য আধ্যত্মিক তত্ত্ব তুলে ধরেন এবং সঙ্ঘ বদ্ধ করেন।তার অনুগামীদের "হরি" নামে মাতোয়ারা হয়ে যেতে বলেন।বৃহৎ সঙ্ঘ গড়ে উঠেছিল হরিচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ কে কেন্দ্র করে। পরবর্তী তে গুরুচাঁদ ঠাকুরের হাতে এই সঙ্ঘের দায়িত্ব আসলে আরো প্রচার প্রসার লাভ করে। গুরু চাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে যা পূর্ব বাংলা য় শিক্ষা বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
১৮৮১ সালে র ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজরা প্রথম ভূমি সংস্কার আইন এবং আদমশুমারি শুরু করে, শুরু হয় পদবী র স্থায়ীকরণ,ও ভূমি নিবন্ধন।এই পদবী নিয়ে ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে বিভিন্ন এলাকায়। গুরুচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা য় এই আন্দোলন বিশেষ রূপ নেয় এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অন্য দিকে,,গড়ে ওঠে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস( ১৮৮৫)।
জাতীয় কংগ্রেস ছাড়াও পরবর্তী সময়ে অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও গড়ে ওঠে।
এই সময়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষার পরিবর্তে নেতারা ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে , স্বার্থান্বেষী মহল ধর্ম কে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করতে লাগলো।
ফলে আমাদের জাতপাতের বেড়াজাল আরো আষ্টেপিষ্টে ঘিরে ফেললো।
ধর্ম রক্ষার ভার পরলো রাজনৈতিক নেতা দের কাঁধে। ধর্ম কাকে বলে??যে ধর্ম কেবলমাত্র আচার অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত, তাকে ধর্ম বলা সঙ্গত নয়। সেই সেই ধর্মাবলম্বীদের যথার্থ ধার্মিক বলে অভিহিত করা যায় না। অবশ্য কতিপয় বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইহাকে যথার্থ ধর্ম বলে ব্যাখা করে থাকেন।যারা সারাজীবনে কখনো" ধর্ম" আচরণ করলেন না, তাদের হাতে ই যখন "ধর্মরক্ষা"ও ধর্মের ব্যাখার দায়িত্ব ন্যস্ত হয় তখন বুঝতে হবে,দেশে দুর্দিন শুরু হয়েছে, একে রোধ করা শক্ত। সাধারণ দরিদ্র , অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, শোষিত মানুষ 'ধর্ম কী' তা না বুঝে তার অপব্যাখার দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে থাকে মূলত নিজের দুর্বলতার কারণেই।এটা তাদের দোষ নয়। বরং দোষ শিক্ষিত সমাজের,যারা 'ইতো-নষ্টতোভ্রষ্টঃ' হয়ে নিজেদের পিতৃপুরুষকে পাগল বলে থাকে।
এদের কথা চিন্তা করে স্বামী বিবেকানন্দ গভীর ক্ষোভের সাথে বলেছেনঃ " Bring light to uneducated, bring more light to the educated."অর্থাৎ যারা অশিক্ষিত তাদের আলো দেখাও, [কিন্তু] যারা শিক্ষিত তাদের আরো বেশি আলোর প্রয়োজন।
পরিশেষে মূল আলোচনায় আসি, আধ্যাত্মিক শিক্ষা, লোক শিক্ষার জন্য মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটে।শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর আবির্ভাব ঘটেছিল লোক শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার জন্য।
সনাতন ধর্মের অন্যতম ৪ টি স্তম্ভ হলঃ ১) ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় (২) জন্মান্তর (৩)অবতার( ৪)মোক্ষ লাভ।
এদিক থেকে হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুগামী রা তাকে অবতার হিসেবে শ্রদ্ধা করেন। পতিত পাবন হিসেবে জীবের উদ্ধার করতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।এটা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটা বিশেষ ধারনা।
"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্ল্যানির্ভবতি ভারত।
অভূ্্যথ্যনম ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।। ৭/৪ গীতা
সনাতন ধর্মের শাস্ত্রমত প্রধানত তিন প্রকার।১) শ্রুতি শাস্ত্র বা উপনিষদ বা বেদান্ত { এখানে ঈশ্বর কে ব্রক্ষ বলা হয়। ব্রক্ষের প্রতীক ওঁ।হরি এক ও অদ্বিতীয়।হরি ওঁ তৎ সৎ} ২)তন্ত্র শাস্ত্র {এখানে শক্তি বলা হয়।তন্ত্রের প্রতীক হংস } (৩) পুরাণ{এখানে ভগবান বলা হয়। ভক্ত ভগবান কে বিভিন্ন নামে উপাসনা করে শ্রীকৃষ্ণ,শ্রীরাম চন্দ্র }।
বর্তমানে আমাদের অজ্ঞতা র কারনে হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট হচ্ছে। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে মূল ভিত্তি থেকে সরে যাচ্ছে।
সনাতন ধর্ম সেমিটিক রিলিজিয়ন নয় অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমন্ডলে সীমাবদ্ধ নয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বৃহৎ পরিমন্ডলে পরম ঈশ্বরচিন্তা, ঈশ্বর উপাসনা, ঈশ্বর লাভের পথ রয়েছে।জ্ঞানপথ, ভক্তি পথ,যোগের পথ , কর্মের পথ। আপনার যেপথ ভালো লাগে সেটা অনুসরণ করার স্বাধীনতা রয়েছে।
এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার আমাদের মধ্যে ভক্ত-ভগবান সম্পর্ক স্থাপনের ভিন্ন তা লক্ষ্য করা যায় অর্থাৎ পুরাণ কেন্দ্রিক ভাবনা। এখানে ভগবান বা অবতার বাদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য অনেক ধর্ম ব্যবসায়ী ভক্ত দের চোখ খুলে দেয় না। এক্ষেত্রে নিজের থেকে সচেতন হতে হবে।
তিনটি প্রধান শাস্ত্রমতের(বেদান্ত মত,তন্ত্রমত, পুরাণ মত) মূল দর্শন উপনিষদ।স্থুলভাবে ভিন্ন মনে হলেও সূক্ষ্ম ভাবে বা দার্শনিক ভাবে এক।[যে কোন ধর্মের তিনটি দিক দার্শনিক দিক বা আধ্যাত্মিক দিক,, পৌরাণিক দিক ও আনুষ্ঠানিক দিক]
বর্তমানে সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি তে তৈরি" মতুয়া"আদর্শে অনুপ্রাণিত লোকজনদের একটা বিশেষ অংশ, মনে করছে তারা হিন্দু সনাতন ধর্মের অন্তর্গত নয়। পৃথক ধর্ম সৃষ্টিতে তৎপর। বিভিন্ন ধরনের ব্যাখা ও অপপ্রচার করে থাকেন। তাদের কাছে বিশেষ অনুরোধ আপনারা সনাতন ধর্মের দর্শন জানুন। সনাতন ধর্মের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্হাপন করুন।
পাঠকগণের কাছে অনুরোধ,
আপনারা ওড়াকান্দির লোগো বা মনোগ্ৰামের গূঢ় ভাবার্থ বুঝুন।(' হরি ওঁ' যা শাশ্বত সনাতন ধর্মের প্রতীক, হংস তন্ত্রের প্রতীক,কুন্ডলীকৃত সাপ যোগ সাধনার প্রতীক)
হরিলীলামৃত তে দেওয়া বাসুদেবের বিগ্ৰহ দেখুন।
ওড়াকান্দির মূল মন্দিরের নিত্য পূজিত "লক্ষী- নারায়নের" বিগ্ৰহ দেখুন।
ঈশ্বর উপাসনায় একক সঙ্গীত, বৃন্দ সংগীত সাম বেদের ই অন্তর্গত।
বেদান্তের নিরাকার ব্রক্ষের উপাসনা র প্রতীক ঘট।প্রত্যেক মাঙ্গলিক কাজে স্থাপন করা হয় এবং নিত্য পূজা করা হয়।
নি এম/লিটু মন্ডল
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com