নালন্দা বিহার ছিলো বর্তমানের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ। বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় মনে করা হয় নালন্দাকে।
বখতিয়ার খিলজির নির্দেশে মামলুক বাহিনী নালন্দা ধ্বংস করার আগে নালন্দার গ্রন্থাগারে বই, দূর্লভ পুঁথি সবমিলিয়ে যার সংখ্যা ছিলো প্রায় ৩ কোটি। গোটা নালন্দা জ্বলেছিলো ৩ মাস ধরে। নালন্দায় মোট ভবন ছিলো ২৭টি।
যখন আমেরিকা নেংটি পরতো সেই ৫ম শতাব্দীতে নালন্দায় জ্যেতির্বিদ্যার চর্চা হতো। নক্ষত্রের উপর গবেষণা চলতো। ন্যায়শাস্ত্র, ভাষার ব্যাকরণ, চিকিৎসা ও সংখ্যা তত্ব ও মানবিক দর্শনের গবেষণা হতো নালন্দায়।
নালন্দায় জ্ঞানপিপাসু ছাত্ররা পড়তে আসতো স্বয়ং ইউরোপ, চীনের রাজ বংশ থেকে।। চীন, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া তিব্বতের অজস্র মেধাবী জ্ঞানপিপাসু ছাত্ররা আসতো নালন্দায়। ৭ম শতাব্দীতেই পর ২ হাজার শিক্ষক, ১০ হাজারের বেশী শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত ছিলো নালন্দা।
বিখ্যাত গবেষক ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ লিখেছিলেন, নালন্দার ইতিহাস হল মহাযান বৌদ্ধধর্মেরই ইতিহাস। হিউয়েন সাং তাঁর ভ্রমণ-বিবরণীতে নালন্দার অবদান হিসেবে যে সকল পণ্ডিতের নাম করেছেন, তাঁদের অনেকেই মহাযান দর্শনের বিকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হিউয়েন সাং যখন নালন্দায় এসেছিলেন তখন প্রবাদপ্রতিম শিক্ষাবিদ মহাস্থবির শীলভদ্র ছিলেন নালন্দার অধ্যক্ষ। এগুলো নালন্দা মন্দির থেকে বিহার হওয়ার পরে।
১৭শ শতাব্দীতে তিব্বতি লামা তারানাথ লিখেছিলেন যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে মৌর্য সম্রাট অশোক নালন্দায় এক বিশাল মন্দির নির্মাণ করান। খ্রিস্টীয় ৩য় শতাব্দীতে বিশ্বখ্যাত দার্শনিক নাগার্জুন ও আর্যদেব ছিলেন নালন্দা বিহারের অধ্যক্ষ।
নালন্দা মহাবিহারের নথিবদ্ধ ইতিহাসের সূচনা ঘটেছিলো গুপ্তযুগে। একটি সিলমোহর থেকে জানা যায় যে, এই মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শক্রাদিত্য নামে এক রাজা। কিন্তু গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর নালন্দার মূলত বিকাশ ঘটে কনৌজের সম্রাট হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপোষকতায়।
হর্ষবর্ধন ই মহাবিহারের মধ্যে পিতলের একটি মঠ নির্মাণ করেছেন এবং ১০০টি গ্রাম (যদিও পরবর্তীতে তা ২০০ গ্রাম হয়েছিলো এর কারণ গ্রামের আয়তন ছিলো বিশাল) থেকে তাঁর প্রাপ্ত রাজস্বের টাকা নালন্দার জন্য বরাদ্দ করেছিলেন। এরপর সেই গ্রামগুলির ২০০ জন অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থকে আদেশ করেছিলেন, তাঁরা যেন মহাবিহারের ভিক্ষুদের চাহিদা অনুসারে প্রতিদিন চাল, মাখন, দুধ, তরি তরকারি পাঠান। তখনকার সময়েই নালন্দার প্রায় এক হাজার শিক্ষক কনৌজে হর্ষবর্ধনের রাজকীয় সভায় উপস্থিত থাকতেন।
পরবর্তীতে গুপ্তোত্তর যুগে দীর্ঘকাল যাবৎ বহু রাজা
নিপুণ হাতের বহু শিল্পী ও ভাস্করদের দিয়ে নতুন নতুন বিহার, মঠ ও মন্দির নির্মাণ করিয়ে যান। কিন্তু তখনো চারপাশে কোন বাউন্ডারি তথা সীমানা প্রাচীর ছিলো না। মধ্য ভারতের এক রাজা নালন্দা মহাবিহার চত্বরের সবগুলো মন্দিরের সুরক্ষিত রাখতে বিশাল এক সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন।
নালন্দা মহাবিহারে ছিলো মোটা বিশালকৃতির ৮টি হল ও প্রায় ৩০০ কক্ষ। এরপর এলো পাল সাম্রাজ্য। পাল সাম্রাজ্যের প্রতিটি রাজাই ছিলেন নালন্দার পৃষ্ঠপোষক। ধর্মপাল ছিলেন নালন্দার অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। পরে তিনিই বিখ্যাত বিক্রমশিলা মহাবিহার নির্মাণ করেছিলেন।
ধর্মপালের ছেলে দেবপাল ছিলেন আরেক কিংবদন্তি পৃষ্ঠপোষক। তাঁর রাজত্বকালেই খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দীতে নির্মিত হয় বিখ্যাত সোমপুর বিহার।
তাঁরা পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঠিক কিন্তু তাঁরা চাইতেন আরো যেন বিস্তার ঘটে শিক্ষার। পালযুগে অন্যান্য মহাবিহারগুলি নালন্দা থেকে বহু কিংবদন্তি শিক্ষিত ভিক্ষুকে গ্রহণ করায় নালন্দা একক গুরুত্ব খানিকটা হারিয়েছিলো।।
কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পরে। বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে মামলুক বাহিনী অথচ সেই কুখ্যাত খুনী বখতিয়ার খিলজিকে আমাদের পাঠ্যবই পড়ানো হয় বীর হিসেবে। যে বাংলা বিজয়ের পথে এবং পরে কিনা আদতে ছিলো এক উগ্রবাদী সন্ত্রাসী। যার প্রধান প্রমাণ নালন্দা ও অজস্র বিহারের ধ্বংসাবশেষ।
ফারসি ইতিহাসবিদ মিনহাজ - ই- সিরাজ তাঁর তাবাকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে বখতিয়ার খিলজির লুটতরাজের বিবরণ দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, বিহার সীমান্তের দুটি গ্রাম খিলজির হাতে সমর্পিত হয়েছিল। এই গ্রামদুটি রাজনৈতিকভাবে কার্যত মালিকানাহীন অঞ্চলে পরিণত হয়। সুযোগ বুঝে খিলজি বিহারে লুটতরাজ শুরু করে। তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তাঁকে এই কাজের জন্য স্বীকৃতি ও পুরস্কার দুইই দেন। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে খিলজি বিহারের একটি দুর্গ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং সেটি দখল করতে সক্ষমও হন। এই দুর্গ থেকে তিনি প্রচুর ধনসম্পত্তি লুট করেছিলেন। ঘটনাটি ঘটেছিল ১১৯৭ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী কোনও এক সময়ে। সেই যুগের অপর দুই বিখ্যাত মহাবিহার বিক্রমশিলা ও পরে জগদ্দল একই সময়ে তুর্কিদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পথেও এই ভয়াবহ উগ্রতা থামেনি।বখতিয়ার খিলজি বাংলা মুখে অগ্রসর হওয়ার সময় একদিন প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গের ন্যায় একটি জায়গায় এসে হাজির হন। সেখানেও স্বভাবসুলভ চড়াও হয়ে বহু অধিবাসীকে হত্যা করেছিলেন এবং কোনো বাধা ছাড়াই জায়গাটি দখল করে নেন। সেখানকার অধিবাসীরা সকলেই ছিল ন্যাড়া মাথার।
এরা ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং দূর্গের মতো জায়গাটির ভিতরে অজস্র বইয়ের সমারোহ। ভিক্ষুদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তিনি জানতে পারেন সেটি কোনো দুর্গ নয়, এটি একটি মহা বিহার। বিহারটির নাম ওদন্তপুরী বিহার। ঐ সময় থেকে বখতিয়ার খিলজির সঙ্গে থাকা জায়গাটির নাম দিলেন বিহার বা বিহার শরীফ। জায়গাটি সেই নামেই এখনও পরিচিত। এভাবেই বিহার জয় করে নেন বখতিয়ার খিলজী। বিহারে এখনও বখতিয়ারপুর নামে একটি জায়গা আছে।
নি এম/
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com