আমি ফিরে আসলাম ইন্ডিয়া থেকে, গত ১৮/১৯ দিন ভালোই কেটে গেলো। ফরিদপুরে আমাদের বাড়িতে কিছুদিন থেকে আমি ফিরে আসলাম ঢাকায়। পড়াশুনার চাপ আবার চাকরিও নাই দুশ্চিন্তা যেনো দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে আমার। গচ্ছিত অর্থ প্রায় কমে যাচ্ছে, চাকরির প্রত্যাশায় অস্হির হয়ে উঠছি। চাকরি যাওবা দুই একটা পাই তাতে আমার হাত খরচও হবে না। প্রথমে বেশি বেতনে চাকরি করলে যা হয় আর কি? আমি অনেক ইন্টারভিউ দিলাম কোথাও সন্তোষজনক কিছু হলো না আমার। একদিন বাংলা মটর কনকর্ড টাওয়ারে ইউরো বাংলায় গেলাম উদ্দেশ্য শ্যামল ব্যানার্জীর সাথে দেখা করা। উনি আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনলেন। উনি আমার ফরিদপুরের বন্ধু মাইকেলের কাকা সেই সুবাদে আমারও কাকা। শ্যামল কাকা চা কফি খাওয়ালো আর বললো এখানেই আপাতত কাজ করো। উনার কথা মতো কাজ শুরু করলাম। ইউরো বাংলার প্রথম কম্পিউটার টি আমার হাত দিয়েই যাত্রা শুরু হয়। তখন অফিস গুলোতে কম্পিউটারের ব্যবহার খুবই কম হতো। যাহোক কিছুদিন এভাবে চলছে। সবার সাথে আন্তরিকতার সম্পর্ক হয়ে গেলো পরিচয় হলো শামীম ভাই, মিজান ভাই, আতিক ভাই আরো অনেকের সাথে। পরিচয় হলো পাশের অফিসের জাহিদ ভাই এর সাথে, জাহিদ ভাই Information Solutions Limited (ISL) এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ISL এর সিংহভাগ শেয়ার হোল্ডারই হলো শাপির খসরু। শাপির খসরু তখন আমেরিকাতে থাকেন, চিনিও না উনাকে। জাহিদ ভাই এর অনুরোধে ISL এ জয়েন্ট করে ফেললাম তবে শ্যামল কাকার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে। শ্যামল কাকা কোন আপত্তি করেন নাই। ISL এর প্রডাক্ট হলো ডেল কম্পিউটার বিক্রি করা এবং বিক্রয় পরবর্তী সার্ভিস দেওয়া। এক একটি ডেল কম্পিউটারের দাম এক থেকে দের লক্ষ্য টাকা। মার্কেটিং অত্যান্ত কঠিন কাজ আর এই চ্যালেঞ্জ'টি নিয়ে নিলাম আমি। ঢাকা'তে হাতে গোনা কিছু অফিস ডেল কম্পিউটার ব্যবহার করে যা কি-না বিদেশী সাহায্যে চলে। যেমন WHO, UNDP, gtz, CARE Bangladesh, Unilever এই ধরনের কোম্পানি গুলো। মাসে দুই তিনটি কম্পিউটার বিক্রি করতে পারলে আমরা ভীষন খুশি। আমাকে কয়েকটি একাউন্ট এ্যালোকেশন করে দিলো অফিস থেকে, এটি মস্ত বড় পরীক্ষা আমার। WHO একাউন্ট এটি খুবই চ্যালেঞ্জর। ISL আগে কখনই তারা DELL কম্পিউটার বিক্রয় করতে পারেনি WHO কাছে। ইতিমধ্যেই আমি মার্কেটিং এর কিছু সুত্র রপ্ত করে ফেলেছি। যেমনটি জেনে ফেলেছি যে, কোন প্রতিষ্ঠানের কি পারসন খুজে বের করা। একজন বিক্রেতা হিসেবে MAN কে আমি যেভাবে দেখি, M= Man, A= Authority, N= Need যে লোকের কাছে এই গুন গুলো আছে, সেই একজন প্রকৃত ক্রেতা। আর প্রতিটি বিক্রয় ঘটে একটি প্রোসেজের মধ্যে আর সেটা হলো- SPANCO প্রোসেজ। আমি ব্যাখ্যা করে দিচ্ছি SPANCO প্রোসেজ কিভাবে কাজ করে-
S= Suspect Call
P= Prospect Call
A= Approach Call
N= Negotiation Call
C= Close Call
O= Order Call
যে কোন প্রডাক্টের বিক্রয় এই সূত্রগুলোর মধ্যেই পড়বে। এই সুত্র হতে পারে Hot বা Warm অথবা Cold এর বাইরে কোন Sales সংগঠিত হতে পারে না। তাই আমি প্রথমে MAN খুজে বের করলাম। মিস্টার ভুইয়া, তিনি WHO এর পোকিউরম্যান্টের।WHO তে আশিটি কম্পিউটার কিনবে বলে জানতে পারলাম যা আমার Suspect Call হিসাবে ট্রিট করলাম। ভুইয়া সাহেবের সাথে সম্পর্ক করা একটা মস্তবড় চ্যালেঞ্জ, খোজ খবর নিলাম তার। ঢাকার গোরাঙ্গে তার বাসা। ছয় সাত বার তার অফিসে যেয়ে দেখা করতে পারলাম না। আমি আর মোরশেদ তার বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এক বিকালে আমি এবং মোরশেদ ভুইয়া সাহেবের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বন্যা এবং বৃষ্টির সময় খিলগাঁও যেয়ে দুই কেজি মিষ্টি এবং আম কিনলাম, খিলগাঁও এর পূর্ব পাশে রীতিমতো নৌকা চলে রাস্তা উপর দিয়ে। অনেক বাড়ী ঘরের নীচ তলা অর্ধেক টা ডুবে গেছে। আমি আর মোরশেদ নৌকা নিলাম, বাড়ির কাছাকাছি আসামাত্রই শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি, নৌকা ভুইয়া সাহেবের বাসার কাছে যেয়ে দাড়ালো, যখনই আমরা দরজার নক কড়লাম, উনি দোতলা থেকে দেখলেন, খুবই রেগে গেলেন আমাদের উপর। আর উপর থেকে গালাগালি শুরু করলেন। আমরা অনেক অনুরোধ করতে থাকলাম, এদিকে আমরা বৃষ্টিতে ভিচ্ছি, উনার বৌ আসলেন তার কাছেও অনুরোধ করলাম, বললাম আমরা দু মিনিট কথা বলেই চলে যাব, ভুইয়া সাহেব নাছোর বান্দা, যাহোক পরে তার বৌ আমাদের প্রতি সদয় হলেন। এদিকে আমরা ভিজে গেছি, একটা গামছা দিলেন আমরা মাথার পানি মুছে ফেললাম, মিষ্টি গুলো তার বৌকে দিতে গেলাম। সে তো আবার রেগে ফায়ার, পরে উনার বৌকে বুঝিয়ে মিষ্টি গুলো দিতে সক্ষম হলাম আমরা। যখনই আমরা কম্পিউটারের কথা উঠালাম সে তো আবার রেগে গেলো। সে রাগ আর থামে না, মহামুস্কিল, আবার তার বৌকে অনুরোধ করতে থাকলাম, অবশেষে সন্ধ্যা সারে সাতটায় আমাদের প্রতি একটু সদয় হলেন। আমাদের অবস্থান উনার কাছে তুলে ধরলাম, বলতে থাকলাম কম্পিউটারের ব্যবসা আপনার ওখানে না করতে পারলে আমাদের কোম্পানি বসে যাবে, চাকরি চলে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিশেষে উনি বললেন আগামী কাল ১২ টার দিকে ধানমন্ডিতে তার অফিসে যেতে। মনে আশার সঞ্চায় হলো, মনে হলো আমাদের Sales Call টা এখন Prospect Call এ রুপান্তরিত হলো। চলে আসলাম ফিরে। পরের দিন সকালে তার দেওয়ার সময় এর দশ মিনিট আগেই পৌছে গেলাম ভুইয়া সাহেবর অফিসে, উনি তখন টেকনিক্যাল ইভালুয়েশন করছিলেন। এক এক করে সব ভেন্ডরদের সাথেই কথা বলেছেন। ঐ টেন্ডারে আমরা ছিলাম সর্বোচ্চ। Approch করলাম। উনি আমাদের প্রতি নমনীয় হলে। Negotiation শুরু হলো। জাহিদ ভাই এর সাথে আলাপ করে অল্প কিছু ছার দিলাম দামে। যদিও আমরা দামে সর্ব নির্ম্মের ধারের কাছেও নাই। অপেক্ষা করতে লাগলাম সিদ্ধান্তের। সন্ধ্যার সময় ভুইয়া সাহেব বললেন তোমাদের জন্য সু-সংবাদ আছে। বুঝতে বাকি রইলো না ডিলটি Close হচ্ছে। উনার কথা মতো সকালে আমি আবার গেলাম। ভুইয়া সাহেব বসতে বললেন। ঘন্টা দুয়েক বসার পরে আমাকে ডাক দিলেন একটা শ্বস্তি ফিরে আসলো- মনে মনে আতঙ্ক কি হয় না হয় এই ভেবে। উনার রুমে ঢোকার পর মুসকি একটা হাসি দিলো সাথে ধরিয়ে দিলো PO- Purchase Order।
জীবনে প্রথম কার্যাদেশ হোক না সেটা একটা কোম্পানির, অভিজ্ঞতা যেটা অর্জন করলাম তা হয়তো সারা জীবনে কাজে লাগবে আমার। ভাবতে ভাবতে অফিসে চলে আসলাম। তখন ISL এর অফিসটি এক রুমের মধ্যে। জাহিদ ভাইকে কার্যাদেশটি হাতে তুলে দিলাম। সে তো আনন্দে আত্মহারা। জাহিদ ভাই তখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর টিচার। আমার প্রথম বিক্রয়ের অভিজ্ঞতাটি উনাকে ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত করলো, দায়িত্ব আরো বাড়িয়ে দিল আমায়, সব চেয়ে কঠিন এ্যাকাউন্ট গুলো আমাকে দেখা শুনার দায়িত্ব দিলেন US Embassy, UNDP, Care Bangladesh, World Bank আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ এ্যাকাউন্ট। এক রুমের অফিস'কে বড় পরিসরে ১২০০০ স্কয়ার ফিটের অফিস বানিয়ে ফেললাম আমরা। আন্তরিকতায় আবদ্ধ হলাম দিপু ভাই, মনি ভাই, মাহবুব ভাই, মোরশেদ, পারভেজ, রাবিদ, বিপাশা, জোবায়ের ওরা সবাই আমার কলিগ, সবাই যেন আমরা একটা পরিবার। হঠাৎ বাদ সাদলো ভাগ্যের। শাপির খসরু সাহেব আমেরিকা থেকে দেশে ফিরলেন। কোম্পানির অবস্থা ভালো দেখে জাহিদ ভাইকে আউট করে দিলেন। আমার মনটা ভেঙ্গে গেলো। আমেরিকান স্টাইলে অফিস চালাতে লাগলেন। মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে লাগলেন। দিপু ভাই, মনি ভাই চাকরি ছেড়ে দিলো, আমার পরীক্ষা সামনে তাই চাকরি আমারও আর ISL এ করা হলো না।
নি এম/
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com