স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টি আসার আগে প্রচন্ড মেঘের গর্জন আর বাতাস শুরু হয়, সন্ধ্যা লাগার এখনো অনেক সময় বাকি তাই ধীরগতিতে হাটতে হাটতে আমি মেনরোড দিয়ে আঙ্গিনা ব্রিজ পার হলাম। কালো মেঘ আকাশ ছেয়ে গেছে। পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসা প্রচন্ড বাতাস সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম আমার সাথে বৃষ্টি ও তার ঝরে পড়ার গতি বাড়াত থাকলো। কোন উপায়ন্তর না দেখে দৌড় শুরু করলাম, বৃষ্টিও নাছরবান্দা কোনভাবে আমার পিছু ছাড়ছে না তাই বৃষ্টিও যেন দৌড় শুরু করলো। আমি দৌড়ে গিয়ে অপু ইন্ডাস্ট্রিজের সামনে ছোট্ট করে টিনের ছাউনি দেওয়া তার মধ্যে দাঁড়ালাম। বাতাসের সাথে ভেসে আসা বৃষ্টির হেসলা আমার গায়ে এসে লাগছে। এরই মধ্যে আমার প্যান্ট গেঞ্জি অনেকটাই ভিজে গেছে। প্রচন্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে এই ভেজা কাপড় চোপড় নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে আমি রাত্রি কোথায় কাটাবো। এমনিতেই আজ বিকেলে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভেজা কাপড়ে আমি টিনের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছি। অনেকক্ষণ এর ভেজা শরীল তাই একটু ঠান্ডা উপলব্ধি করছি। এরই মধ্যে একটা ট্রাক এসে অপু ইন্ডাস্ট্রিজ এর সামনে দাঁড়ালো। ট্রাকের দরজা খুলে কেউ একজন লাফ দিয়ে নেমে ঠিক টিনের ছাউনির নিচে এসে দাঁড়ালো। সারা গায়ে ময়দা লেগে আছে মাথায় গামছা বাঁধা খুলে গা পরিষ্কার করছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও আমার গ্রামের ছেলে জীবন, জীবন অধিকারী। জীবন অধিকারী এই ময়দার মিলের কুলির কাজ করে। জানতে চাইবার আগেই উত্তর দিল ট্রাকে করে ময়দা ডেলিভারি দিয়ে আসলাম। জীবন অধিকারী আমাকে ডেকে অপু ইন্ডাস্ট্রিজ এর ভেতরে নিয়ে গেল। গামছা দিয়ে বলল গা মুছে নে। এবার বল এখানে কি মনে করে? আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে ওকে সব বলতে শুরু করলাম। বলা শেষ না হতেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল রাতে শুনবো। মনে মনে খুশি হয়ে গেলাম অন্তত মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই হলো। জীবন অধিকারী ময়দার মিলের ভেতরেই থাকে। চতুর্দিকে ময়দার বস্তা মাঝখানে একটা সরু গলি। সরু গলিতে একটু হাঁটতে সামনে গিয়ে দুজনে দুই ময়দার বস্তার উপরে বসে পরলাম। দুজনের একই নাম তাই ইতিমধ্যেই আমরা একে অপরের নামে নামে মিতা বনে গেলাম।
এরই মধ্যে রাত দশটা বেজে গেলো বৃষ্টি আর থামছে না, প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে, খাবারের কোন ব্যবস্হা নাই, রান্নার ও কোন জায়গা নাই মিলের মধ্যে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, হয়তো অনাহারে রাত কাটাতে হবে। রাত তখন প্রায় বারটা ক্ষুধার জ্বালা আর সহ্য করতে পারছিনা মিতাকে বললাম কিছু একটা করো। মিলে একটা টিনের থালা ছিলো খুঁজে বের করা হলো, ময়দা গুলিয়ে চাপরি বানালাম, লবনও ছিলো না যে একটু মিশিয়ে নিবো। লবন ছারা ময়দার চাপরি খেতে কি আর ভালো লাগে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় খেতে বাধ্য হলাম। শুবারও জায়গা নাই মিলের মধ্যে দুই পাশে সারি সারি ভাবে ময়দার বস্তা সাজিয়ে রাখা সেখানে দুই মিতা ময়দার বস্তা বিছিয়ে শুয়ে পরলাম। পরেরদিন একটু দেরি করে ঘুম ভাঙলো। ক্লান্তিতে মনে হয় একটু বেশি ঘুমিয়ে পরেছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি একই ভাবে বৃষ্টি নামছে। বের হওয়ার কোন সুযোগ নাই, পকেটে টাকাও নাই দুর্চিন্তার পাহাড় ভেঙ্গে পরছে মাথায়, কি করবো বুঝে উঠতে পারছিনা। মন খুলে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে শুরু করলাম, হে সৃষ্টিকর্তা আমাকে উদ্ধার করো, এই বিপদ থেকে আমাকে বাঁচাও। দুপুরও গরিয়ে যাচ্ছে, পেটে ক্ষুধা তো আর শুনছেনা আমার এই অসহায়ত্ত্বের কথা। কি আর করা আবার একই ভাবে লবন ছারা ময়দার চাপরি গলা দিয়া ঢুকছেনা, এভাবেই একটু খেলাম শুধুই বেচে থাকার জন্য।
দিনটা চলে যেয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, মনে হচ্ছে আমরা দুজনেই খাবারের অভাবে মারা যাচ্ছি। হাত পা যেন অবশ হয়ে আসছে। মুখ দিয়ে কারো কোন কথা বের হচ্ছে না। আমার মিতা হটাৎ করে বলল - ময়দার বস্তা চুরি করে বিক্রি করি চলো কিন্তু আমার বিবেক ওর কথায় শায় দিলো না। আমি ওকে বাধ্য করলাম বিবেক বহির্ভূত কাজ না করার জন্য। যতই রাত্রি হচ্ছে খুদার যন্ত্রণায় আমরা দুজনেই যেন নিস্তেজ হয়ে পরছি। সৃষ্টিকর্তা কে ডাকছি হৃদয় দিয়ে, চোখের জল যেনো শুখিয়ে যাচ্ছে মুখমন্ডলে, কন্ঠে যেনো আর স্বর বের হচ্ছে না। মৃত্যুর কোলে যেনো ঢলে পরছি। শরীলের সমস্ত শক্তি যেন অকেজো হয়ে গেলো। আমরা মারা যাচ্ছি। হায় ঈশ্বর এতো তারাতারি বিদায় জানাতে হচ্ছে এই পৃথিবীকে। হটাৎ আজানে শব্দ, মনে হলো ভোর হয়ে গেছে। একটু কষ্ট করে মিলের মেইন গেট খুললাম ভোর হওয়া সত্বেও অন্ধকার কাটেনি, বৃষ্টি ও থামেনি, আকাশে মেঘ গর্জন করছে। অপু ইন্ডাস্ট্রির সামনের মাঠটি পানিতে থৈ থৈ করছে। বড় বড় ব্যাঙ ডাকছে, হটাৎ করে রাস্তার দিকে তাকালাম, কি যেনো লাফাচ্ছে, চোখের চাওনি একটু বড় করে দেখার চেষ্টা করছি এদিকে আমার মিতা আমার প্রানের বন্ধুটি কাছে এসে দারিয়েছে। দুজনেই দেখতে চেষ্টা করছি কি ওগুলো? একটু এগোতেই চিনে ফেললাম। ওগুলো অন্য কিছু না সবই ঈশ্বর প্রদত্ত বড় বড় সাইজের কৈ মাছ, একটা দুইটা না শত শত কৈ মাছ রাস্তার উপরে উঠেছে। প্রকৃতির এই দৃশ্য দেখে বিদ্যুৎ চমকানো মতো আমাদের শরীলে এনার্জি চলে আসলো। হটাৎ করেই অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যেনো সচল হয়ে গেলো। দুজনেই লেগে গেলাম কৈ মাছ ধরতে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমরা দুজনে আধা বস্তা কৈ মাছ ধরে ফেললাম, ঐ কৈ মাছ গুলো নিয়ে আমরা দুজন হাজি শরিওতুল্লা মাছ বাজারে গেলাম কৈ মাছ গুলো বিক্রি করব বলে। দুজনের চোখে মুখের স্বস্তির এক অজানা আনন্দ যা বলে বোঝানোর ভাসা আমার জানা নাই, আমি নির্বাক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চলবে.....
নি এম/
Editor & Publisher : Sukriti Mondal.
E-mail: eibelanews2022@gmail.com