eibela24.com
শুক্রবার, ২৯, মার্চ, ২০২৪
 

 
মহৎপ্রাণ শ্রীদামচন্দ্র জয়ধরের সংক্ষিপ্ত জীবনকথা "
আপডেট: ১১:৪৮ pm ১৭-০৯-২০২০
 
 


নিষ্ঠাবান, সদাশয়, পুণ্যবান ও তত্ত্বদর্শী পুরুষ ছিলেন মহৎপ্রাণ শ্রীদামচন্দ্র জয়ধর (১৯২৯-২০০২)। তিনি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলাধীন উত্তরসাজুরিয়া (চৌদ্দমেদা) গ্রামে পিতা চণ্ডীচরণ জয়ধরের ঔরসে, মাতা বিরজাসুন্দরী দেবীর কোল আলো করে ভূমিষ্ঠ হন। মিথুন রাশিস্থ জাতক শ্রীদামচন্দ্র ছিলেন শৌর্য-বীর্য ও পরাক্রমশালী ঐতিহ্যবাহী " জয়ধর " বংশের আদিপুরুষ যশোর জেলার ঝিকরগাছা নিবাসী মহাত্মা মথুরনাথ মহাশয়ের দশম অধঃস্তন পুরুষ। মথুরনাথের পুত্র শ্রীমন্ত তৎপুত্র মহেশচন্দ্র তৎপুত্র হরিচরণ তৎপুত্র রূপচাঁদ জয়ধর। রূপচাঁদ জয়ধর উত্তরসাজুরিয়া গ্রামের প্রথম বসতি স্থাপনকারী ব্যক্তি। তিনি গোপালগঞ্জ জেলার বান্ধাবাড়ি গ্রাম থেকে উত্তরসাজুরিয়া গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। তিনিই গ্রামটির গোড়াপত্তনকারী আদি বাসিন্দা।  রূপচাঁদ জয়ধরের পুত্র  জীবনকৃষ্ণ। জীবনকৃষ্ণের পুত্র ডাবারীচরণ। ডাবারীচরণের পুত্র মানিকচন্দ্র।  মানিকচন্দ্রের তিন পুত্র হারাণকৃষ্ণ, ভরতচন্দ্র ও নিমাইচন্দ্র।   হারাণকৃষ্ণ জয়ধরের তিন পুত্র গুরুচরণ, চণ্ডীচরণ ও ঝড়ুচরণ। চণ্ডীচরণের তিন পুত্র ভুবন জয়ধর, লক্ষ্মণ জয়ধর এবং শ্রীদামচন্দ্র জয়ধর।

পিতার কনিষ্ঠ সন্তান শ্রীদামচন্দ্র পরাক্রমশালী বংশে জন্মগ্রহণ করেও শৈশব থেকেই ছিলেন শান্ত প্রকৃতির। ধর্মীয় কাজের প্রতি ছিল একাগ্র নিষ্ঠা। ক্রীড়ানৈপুণ্যেও ছিলেন পারদর্শী। তাঁর সরলমতি চিন্তা-চেতনা সবাইকে আকৃষ্ট করত। নিজগৃহে পাঠশালার গুরুর নিকটে বিদ্যাশিক্ষার হাতেখড়ি দেন পাঁচ বছর বয়সে। নিজ বাড়িতে অবস্থিত ইংরেজ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নিম্ন ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। পরে চেঙ্গুটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও আগৈলঝাড়া ভেগাই হালদার পাবলিক একাডেমিতে অধ্যয়ন করেন। চেঙ্গুটিয়া বিদ্যালয় থেকে মাত্র একজন ছাত্র চতুূর্থ শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় টরকী কেন্দ্রে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করেন,  তিনি হলেন শ্রীদামচন্দ্র। তের বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ ঘটলে অপ্রত্যাশিতভাবে শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটে। জীবিকার তাগিদে কর্মজীবনকে বরণ করে শক্ত হাতে হাল ধরেন সংসারের। তিনি কৈশোর থেকেই ছিলেন কর্মনিষ্ঠ সুপুরুষ। কখনও কর্মে অবহেলা করতেন না। প্রচুর কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করলেও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও জ্ঞানশাস্ত্র স্বতঃস্ফুর্ত উৎসাহের সাথে পঠন, পাঠন ও অধ্যয়ন করতেন। পরমতসহিষ্ণুতা ও সত্যবাদিতার সাথে জীবন নির্বাহে সচেষ্ট থাকতেন। সকল মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। মানুষের সাখে সদ্ব্যবহার করতেন। সমদর্শী শ্রীদামকে সবাই আন্তরিকভাবে ভালোবাসত।

১৯৪৩ সালে চৌদ্দ বছর বয়সে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ধর্মগুরুর শ্রীমৎ রমণীরঞ্জন গোস্বামীর নিকট থেকে  দীক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে (ফাল্গুন ১৩৫২ বঙ্গাব্দ) ষোল বছর বয়সে বাশাইল নিবাসী স্বর্গীয় মঙ্গল মজুমদারের কনিষ্ঠ কন্যা মেনকাদেবীর সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। শ্রীদাম অশ্বপৃষ্ঠে আরোহনপূর্বক বিবাহের নিমিত্তে শ্বশুরালয়ে গমন করেন।

১৯৪৬ সালে বিশিষ্ট ধর্মতত্ত্ববিদ বরেণ্য আচার্য শ্রী শ্রী জ্ঞানেন্দ্রনাথ গোস্বামীর নিকট থেকে শিক্ষামন্ত্র লাভ করেন। ন্যায়নিষ্ঠ জীবনাচরণ ও একাগ্র কর্মনিষ্ঠার দ্বারা গুরুকুলের সকল কর্ম দ্রুত আয়ত্ত করতে সমর্থ হন। অভ্রান্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন ও বৈষ্ণবীয় দর্শন চর্চা করে তত্ত্বজ্ঞ সাধকে পরিণত হন। গীতাপাঠ ছিল তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম।গীতা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। ১৯৭০ সালে সুযোগ্য জ্যেষ্ঠপুত্র সুবোধ দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে যখন মৃত্যুশয্যায় তখন শ্রীদাম শিয়রে বসে গীতা পাঠ করে পুত্রের বুকের উপরে রাখেন। হঠাৎ গীতা মেলে বের হয়ে আসে দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২৭ নং শ্লোক -
" জাতস্য হি ধ্রুবো.........  "
অর্থাৎ জন্মিলে মৃত্যু নিশ্চিত....অতএব শোক করা বৃথা। 
তৎক্ষণাৎ সুবোধ ইহলোক ত্যাগ করেন। বাড়ির লোকজন, প্রতিবেশি সকলে মহাশোকাচ্ছন্ন হয়ে গগনবিদারী কান্নার ধ্বনি তুললে গীতার বাণীতে অনুপ্রাণিত শ্রীদাম সবাইকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন অশ্রুপাত তো দূরের কথা। অধ্যাত্ম জ্ঞানসম্পন্ন শ্রীদামের এই অবস্থা দেখে সবাই অবাক হলেন। অসীম ক্ষমতায় শোক সংবরণ করে গীতাজ্ঞানের আলোকে আলোকিত আদর্শ জীবন গঠন করেছিলেন। তিনি সর্বদা মনে-প্রাণে কৃষ্ণচিন্তা করতেন। নিদ্রামগ্ন অবস্থায় কৃষ্ণনাম জপ করতেন।

শ্রীদামচন্দ্র ছিলেন মহৎ ও পরমতসহিষ্ণু স্থৈর্যবান পুরুষ। সুদৃঢ় প্রজ্ঞা ও অপরিমেয় জ্ঞানের অধিকারী শ্রীদাম ছিলেন ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর এক শুদ্ধতম সাধক। মানবকল্যাণে তিনি অনেক জনহিতকর কর্মে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন। অভ্রান্ত শাস্ত্র অধ্যয়ন, ধর্মানুশীলন ও ঈশ্বরের প্রতি একাগ্র সাধনার ফলে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন। বিভিন্ন ধর্মসভায় সনাতন ধর্মের তত্ত্ব ও দর্শন সম্পর্কে প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা প্রদান করতেন। বৈষ্ণব দর্শন,  কৃষ্ণতত্ত্ব, ভগবদজ্ঞান ও সাধনজগতের অন্তর্গূঢ় রহস্য আলোচনা করতেন অবলীলাক্রমে। বিভিন্ন ধর্মানুষ্ঠানের তিনি ছিলেন মধ্যমণি। আর্তজিজ্ঞাসু ভক্তদের বিবিধ প্রশ্নের যথোপযুক্ত ও হৃদয়গ্রাহী জবাব প্রদানের মধ্য দিয়ে হয়েছেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়। হরিবাসরে আধ্যাত্মিক ও দেহতত্ত্ব সম্পর্কিত সংগীত এবং বৈষ্ণব পদসমূহের সুন্দর ব্যাখ্যা দিতেন। সহজ-সরল ভাষায় বিশ্লেষণসহ গীতার আলোচনার মাধ্যমে জ্ঞানপিপাসু মানুষকে আকৃষ্ট করেছেন। সপ্তশতী গীতা তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। একবার উত্তরসাজুরিয়া গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষে মাটি কাটার কাজ উদ্বোধন করতে আসেন রাজিহার ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান এস. এম. আফজাল হোসেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে  শ্রীদামচন্দ্র গীতা পাঠ করার জন্য অগ্রসর হন। চেয়ারম্যান মহোদয় সাধুকে না দেখে গীতা পাঠ করতে বলেন। শ্রীদামচন্দ্র সেদিন গীতার চতুর্থ অধ্যায় জ্ঞান যোগের বিয়াল্লিশটি শ্লোক অনুবাদসহ না দেখে পাঠ করে সবাইকে অবাক করে দেন। চেয়ারম্যান তো জানতেন না সাধু শ্রীদামচন্দ্র গীতার শ্লোক অনায়াসে না দেখে বলতে পারেন।  মানবতা ও সাম্য চিন্তার ধারক শ্রীদামচন্দ্র মানবকল্যাণে অশেষ অবদান রেখেছেন। গ্রামবাসীর প্রচেষ্টায় উদ্যোগ নেয়া প্রস্তাবিত উত্তরসাজুরিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে শ্রীদামচন্দ্র জয়ধরকে বরণ করে নেয়া হয়।  শিক্ষা বিস্তারের লক্ষে গীতার জ্ঞান যোগের উদ্ধৃতি ও ব্যাখ্যা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন। শিশুরা তাঁর গল্প শোনার জন্য সদলবলে ঘিরে রাখত। শিশুদের ধর্মগ্রন্থের হিতোপদেশমূলক গল্পের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা দিতেন। জ্ঞাতিত্ব, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ ও সম্প্রীতি বোধের জাগরণ ঘটাতে মহাভারতের উপাখ্যান শুনিয়ে উপদেশ দিতেন।
২০০২ সালের ৩, ৪ ও ৫ এপ্রিল  গোপালগঞ্জের রাজাপুরে অনুষ্ঠিত তিনব্যাপী জয়ধর জ্ঞাতি মহাসম্মেলনে অন্যতম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই মহতী অধিবেশনে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ ও প্রবচন দান করে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন।

মহৎপ্রাণ শ্রীদামচন্দ্র জয়ধর ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ সেপ্টেম্বর(৩০ ভাদ্র ১৪০৯ বঙ্গাব্দ)সোমবার একাদশী তিথিতে উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে শোভনযোগে সূর্যদেব যখন অস্তরাগে হেলে পড়েছে তখন ৫.২৬ মিনিটে ইহলোক ত্যাগ করে পরলোক গমন করেন। মহাত্মনের প্রয়াণদিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় গেয়ে উঠি  ----

" মহৎপ্রাণ, উদারচিত্ত শ্রীদামচন্দ্র জয়ধর,

চিরসুখে থাকো তুমি হয়ে অমর।

সমাজকে যাহা তুমি করে গেলে দান,

অক্ষয়,অব্যয় তাহা চিরঅম্লান।

তোমার কর্মজগৎ চিরস্মরণীয়,

তাই তুমি জনমানবের বরণীয়।  "

নি এম/দিনেশ চন্দ্র